পথভোলা মুসাফির ( উপন্যাস )

লিখেছেন লিখেছেন একপশলা বৃষ্টি ০২ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:১৪:৫৫ দুপুর

এক

বয়ে চলেছে খড়স্রোতা ফুরাত নদী। উপকূল জুড়ে বিস্তৃত চরাঞ্চল। একপাশে ছোট্ট একটি তাবু। সামনে গাছপালা আচ্ছাদিত বেশকিছু বাড়িঘর, একটি মাঝারি মানের গ্রাম্য বসতির মতো দেখাচ্ছে। তাবুর ভেতরে এক যুবক বসে আছেন। সামনে ছোট্ট একটি শিশু-সন্তান খেলা করছে। গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন তিনি। চোখদুটি ছেলেটির উপর নিবদ্ধ। উদাসী দৃষ্টি তাঁর। মাঝেমধ্যে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাবুর পিছন দিকে উঁকি দিচ্ছেন, যেদিকটায় কুলকুল রবে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জল¯্রােতের শতাব্দি-প্রাচীন এ নদী। বাতাসের তালে তালে পানিতে দোল খাচ্ছে। কখনও কিছুটা উঠে আসছে, কখনও নেমে যাচ্ছে, যেন তীরে এসে বালির গায়ে পরম স্নেহের হাত বুলাচ্ছে।

যুবকটির নাম আব্দুর রাহমান বিন মুআবিয়া বিন হিশাম। সদ্য পতন হওয়া উমাইয়্যা বংশের শাহজাদা তিনি। সবর্শেষ শাহজাদা। তাবুর বাহিরে যে শিশুটি খেলা করছে, সেটা তাঁরই সন্তান। নাম সুলাইমান, সুলাইমান বিন আব্দুর রাহমান। বনু আব্বাসের হাতে বনু উমাইয়্যা খিলাফতের পতন ঘটলে ওরা তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করে ফেলে। তিনি আপন ছোট ভাই, মুক্ত করে দেয়া বদর নামের এক গোলাম ও একমাত্র শিশুপুত্রটিকে নিয়ে পালিয়ে আসেন এবং কোনোমতে এদিকটায় এসে জীবন বাঁচান।

ছোট ভাই জরুরি কিছু জিনিসপত্র কিনে আনতে সামনের বসতিতে গেছে। বদরও সাথে আছে। এই মুহূর্তে তাবুতে অন্য কেউ নেই। একাকী বসে আছেন তিনি। মনটা যতটা বিষণœ তারচেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা পুরোপুরি ঝেঁকে বসেছে। নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করছেন। তাই মাঝেমধ্যে সামনের উন্মুক্ত মাঠের দিকে তাকাচ্ছেন। ছেলেটা খেলা করছে সেদিকে।

হঠাৎ চকিত-চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বদর প্রাণপণ ছুটে আসছে তাঁর দিকে। পরিস্থিতি আঁচ করা কঠিন কিছু নয়, গোলমাল আছে নিশ্চিত। তিনি দ্রুত তাবু থেকে বেরিয়ে এলেন। বদরকে সম্ভোধন করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সে সুযোগ পেলেন না। তার আগেই বদর চেঁচিয়ে উঠল,

“আমীর! পালান, পালান। তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়ার চিন্তা করুন। বনু আব্বাসের সৈন্যরা আমাদের সন্ধানে এখানেও এসে পৌঁছে গেছে। বিলম্ব করা ঠিক হবে না, তাড়াতাড়ি চলুন। দেরি করলে মারা পড়ব। ওরা আমাদের ঘিরে ফেলবে। এসে পড়েছে, ওরা এসে পড়েছে।” বদর দৌঁড়াচ্ছে আর কথা বলছে।

অজানা আতঙ্ক এসে ভর করল। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। প্রথমেই জানতে চাইলেন, “আমার ভাই কোথায়? আসছে তো?”

বদর দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে চাইল না। তাবুর দিকে যেতে যেতে জবাব দিল,

“আপনি চিন্তা করবেন না। তিনিও চলে আসবেন। আমার পিছে পিছে দৌঁড়াচ্ছিলেন। এদিকেই আসছেন।”

আব্দুর রাহমান বিন মুআবিয়ার জন্য এ এক কঠিন পরিস্থিতি। মাত্রই পালিয়ে এসেছেন, ভাই বাহিরে গেছে, এ অবস্থায় মৃত্যু তাড়া করে ধেয়ে আসছে। নিজেও তাবুতে প্রবেশ করলেন। এককোণে এগিয়ে গিয়ে ঢাল তুলে নিলেন। নিজ হাতে পিঠে বাঁধলেন। এরপর বদরের দিকে তাকালেন। বদর চামড়ার একটি বড় থলে হাতে নিল। শুন্য থলেটিতে কিছু একটা ভরে নিল। সেটা পিঠে বেঁধে তার উপর ঢালও বেঁধে নিল। কাজ শেষ। আবারও বদরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল,

“আমীর! দ্রুত চিন্তা করুন, দ্রুত। ওরা এক্ষুণি চলে আসবে। আমার মনে হয়, আমাদের সামনে কেবল একটি পথই খোলা আছে, সেটা হল, কোনো চিন্তাভাবনা না করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এরপর সাঁতরে ওপারে পৌঁছে যাওয়া। এছাড়া আত্মরক্ষার উপযুক্ত কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।”

আব্দুর রাহমান বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঐ অবস্থায়ই মাথা নাড়ালেন, সম্মতি জানালেন। ইশারা স্পষ্ট, তিনিও বদরের সাথে একমত পোষণ করছেন। এবার তাঁর ছোট ভাইকেও দেখা গেল। সে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তাবুর দিকে আসছে। একই সাথে বিপদের উপস্থিতিও গোচরীভূত হয়ে উঠল। বসতির বাহিরে কয়েকজন আশ্বারোহীর উপস্থিতি লক্ষ করা গেল। হাতে উন্মুক্ত তরবারি, তীব্র থেকে তীব্রতর অশ্বের গতি, এরা ধাওয়াকারী, এরা বনু আব্বাসের সশস্ত্র সেনা। আব্বাসীদের কালো নিশান পতপত করে উড়াতে উড়াতে দ্রুত বেগে এদিকেই অগ্রসর হচ্ছে।

এ দৃশ্য দেখে আব্দুর রাহমান ও বদর চোখে চোখ রেখে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে নিলেন। বদর আগে থেকেই প্রস্তুত। পিঠে প্রয়োজনীয় মালপত্র বোঝাই করে নিয়েছে। আব্দুর রাহমান হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠলেন। শিশুটিকে ঝাপটে ধরে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একই সাথে ছোট ভাইকেও নদীতে ঝাঁপ দিতে চিৎকার করে করে ডাকতে লাগলেন।

ওদিকে আব্বাসীয় সেনারা পতাকা উড়াতে উড়াতে একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেল। ওরা নানাধরণের হাঁকডাক দিয়ে যাচ্ছিল। কখনও আব্দুর রাহমান বিন মুআবিয়াকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছিল, কখনও তাঁর ছোট ভাইকে নিশ্চয়তা দিচ্ছিল, আবার কখনও বদরকে ডেকে ডেকে অভয় দিচ্ছিল। সৈন্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, আব্দুর রাহমান ও তাঁর সাথীরা যেন বিশ্বাস করে নেনÑভয়ের কিছু নেই, ওরা কোনো ক্ষতি করবে না।

আব্দুর রাহমান ও বদর এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ। এদের ডাকে সাড়া দেবার কোনো কারণই দেখলেন না। মুহূর্তেই ঝাঁপ দিলেন আর দ্রুত সাঁতার কেটে নদীর মাঝামাঝি চলে গেলেন। এদিকে ছোট ভাই কখনও এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেনি। এই হতভাগা ওদের আন্তরিকতা দেখে বিশ্বাস করে বসল। সে নদীতে না পড়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারল, ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। কাছে এসেই বনু আব্বাসের সেনারা উদ্যত তরবারি দিয়ে এক আঘাতে মস্তক ছিন্ন করে ফেলল।

আব্দুর রাহমান শিশুপুত্র সুলাইমান ও ভূত্য বদরকে সাথে নিয়ে সাঁতার কেটে কেটে ওপারে গিয়ে উঠলেন। ধাওয়াকারী বনু আব্বাসের সেনাদের নাগালের বাহিরে চলে গেছেন, ওদের কিছুই করার রইল না। ফলে সেনারা ফিরে যেতে বাধ্য হল। আব্দুর রাহমান, বদর ও সুলাইমান তীর ঘেঁষে আস্তে আস্তে উঠে এলেন। তাঁরা এখন বিপদমুক্ত, নিরাপদ।

সবাই নদীর পাড়ে উঠে এলেন। আব্দুর রাহমান মাটিতে বসে পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তিনি ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত, বিমর্ষ ও দিকভ্রান্ত। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাটিয়ে দিলেন। এরপর আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকালেন। ব্যথিত কণ্ঠে বদরের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন,

“বদর! ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে খুব কষ্ট পাচ্ছি। মূলত: ওরা অভয় দিয়ে, বিশ্বাস যুগিয়ে তাকে প্রলুব্ধ করে ফেলেছিল। ফলে সে প্রতারিত হয় এবং ধরা খায়। উফ! তার কাজটা মোটেও উচিত হয়নি। এমনটা না করে আমাদের সাথে সাথে লাফিয়ে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হত। বনু আব্বাসের এসব নরপিশাচ একটা অসহায় ছেলেকে বাগে পেয়ে নিজেদের সব রাগ উগড়ে দিয়েছে। দুর্বলের উপর আঘাত করে নিজেদের ক্রোধাগ্নি প্রশমিত করেছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। তীব্র যন্ত্রনায় মনটা ছটফট করছে। তবে এ কথা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি যে, তুমি ঠিক সময়ে এসে আমাকে অবগত করেছিলে। যার ফলে সন্তান নিয়ে নিরাপদে নদী পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছি। সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে পেরে কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি।”

[চলবে]

বিষয়: বিবিধ

১০৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File